ভাড়া নির্ধারণে উপেক্ষিত যাত্রী স্বার্থ

Passenger Voice    |    ১২:১৪ পিএম, ২০২১-১১-২৪


ভাড়া নির্ধারণে উপেক্ষিত যাত্রী স্বার্থ

কোনো ধরনের পূর্বঘোষণা ছাড়াই সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে পুরো দেশ অচল হয়েছিল এবং গণপরিবহণ ও পণ্য পরিবহণের যাত্রীরা জিম্মি হয়েছিল।

সে অচলাবস্থা কাটাতে তিন দিন পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সভা বসে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণপরিবহণের ভাড়ার হার ও সর্বনিু ভাড়া নির্ধারণ ও পুনঃনির্ধারণ করতে। জিম্মিদশা চলাকালীন গণপরিবহণ মালিকদের কাছ থেকে নানারকম দাবি শোনা গেলেও ভাড়া বাড়ানোই ছিল মুখ্য। যদিও তারা এভাবে জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের ঘটনা ইতঃপূর্বে ঘটালেও এর জন্য তিরস্কৃত না হয়ে অনেকেরই পুরস্কৃত হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে। ফলে এ রোগটি এখন আর গণপরিবহণে সীমাবদ্ধ নেই। সংক্রমিত হয়েছে অন্য ব্যবসা ও সেবার ক্ষেত্রেও।

ভোক্তা ও গণপরিবহণ খাতের সংশ্লিষ্টদের মতে, বাসভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাসভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাস পরিচালনায় যাত্রীদের নয়, গণপরিবহণ মালিকদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি আছে, যার ১৪ সদস্যের সাতজনই মালিক সমিতির নেতা। বিআরটিএর ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে ভোক্তাদের একজন প্রতিনিধি থাকলেও নৌপরিবহণ খাতে ভোক্তা প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগই রাখা হয়নি। ফলে নৌপরিবহণ খাতে ব্যবসায়ী ও বিআইডব্লিউটিএ মিলে ভাড়া নির্ধারণ করেন। বাকি সাতজনের ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা এবং ভোক্তা প্রতিনিধি হিসাবে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন প্রতিনিধি থাকলেও মালিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তারাই সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। যাত্রীদের স্বার্থ সবসময়ই উপেক্ষিত থেকে যায়।

বাসভাড়া বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারির পর ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও গণপরিবহণ মালিকরা রুট ভেদে ৫০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছেন। এছাড়া সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের রাখার কথা বলা হলেও ভোক্তাদের (যাত্রী) প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য না থাকলে সেখানে ভোক্তাদের নামে মন্ত্রণালয়ের আশীর্বাদপুষ্ট লোকজন অংশগ্রহণ করবেন। ক্যাবসহ যাত্রীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত অন্য নাগরিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে যান চলাচলের অনুমোদনকারী আঞ্চলিক পরিবহণ কমিটিতে (আরটিসি) ভোক্তাদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করে আসছিল। ফলে যাত্রীদের অধিকারের বিষয়গুলো বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকেই যায়।

আমরা জানি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী অধিকাংশ বাসই লক্কর-ঝক্কর। ভাড়া নির্ধারণে যে প্যারামিটারগুলোকে আমলে নেওয়া হয়, সেখানে শুভঙ্করের ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে গণপরিবহণ মালিকরা ভাড়া নির্ধারণে এসব বাসের মূল্য ধরেন গড়ে ৩৫ লাখ টাকা। ব্যাংক ঋণে কেনা এসব বাসের সুদ পরিশোধ ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১০ লাখ টাকা। পাশাপাশি নিবন্ধন ফি ৪২ হাজার টাকা। এসব মিলিয়ে প্রতিটি বাসের পেছনে গড় বিনিয়োগ ব্যয় পড়েছে প্রায় ৪৬ লাখ টাকা। সারা দেশে দূরপাল্লার রুটগুলোয় চলে বিভিন্ন মানের বাস। তবে এসব (নন-এসি) বাসের মূল্য ধরা হয়েছে ৭৫ লাখ টাকা। ব্যাংক ঋণে কেনা এসব বাসের জন্য সুদ পরিশোধ করতে হবে সাড়ে ২২ লাখ টাকা। সঙ্গে যুক্ত হবে নিবন্ধন ফি ৪২ হাজার টাকা। এতে প্রতিটি দূরপাল্লার বাসের পেছনে বিনিয়োগ ব্যয় পড়েছে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা। শুধু বাসের দামই নয়, ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিমা খরচ, টোল খরচ, প্রতি মাসে টায়ার-টিউব পরিবর্তন, ছয় মাসে দুটি ব্যাটারি বদল, নিয়মিত বাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতি পাঁচ বছরে বাস রেনোভেশন করা ইত্যাদি অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ধরা হয়েছে। এছাড়া বাসের গ্যারেজ ভাড়া, ভবিষ্যতে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতিও দেখানো হয়েছে ভাড়া নির্ধারণে। এভাবেই ১৬টি খাতে ব্যয় যোগ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতি কিলোমিটার বাসভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। আগে এ হার ছিল ১ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া ৪৫ পয়সা তথা সাড়ে ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর দূরপাল্লার বাসভাড়া দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৮০ পয়সা। আগে এ হার ছিল ১ টাকা ৪২ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া ৩২ পয়সা তথা ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যদিও বাসভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণে রয়েছে নানা ফাঁকি। ফলে ভাড়া বৃদ্ধির নামে মূলত বোঝা চেপেছে যাত্রীদের কাঁধে। যদিও পরিবহণ খাতের বিশেষজ্ঞরা বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণে বিবেচিত অধিকাংশ উপাদানকেই অপ্রয়োজনীয়, কাল্পনিক ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মত প্রকাশ করেছেন।

বিআরটিএ ব্যয় বিশ্লেষণে প্রতিটি বাসের গড় আয়ুষ্কাল ধরেছে ১০ বছর। আর বাসগুলো বছরে চলবে ৩০০ দিন। বলা হয়েছে, আসনের ৯৫ শতাংশ যাত্রী বহন করবে বাসগুলো। যদিও অধিকাংশ সময় আসনের চেয়ে দ্বিগুণ যাত্রী বহন করে বাসগুলো। তবে ৯৫ শতাংশ যাত্রী বহন দেখিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করায় কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বেশি পড়েছে। হিসাবে প্রতিটি বাসে গড়ে প্রতি মাসে টায়ার-টিউব পরিবর্তন করায় বছরে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার টাকা। এর বাইরে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ইঞ্জিন ওভারহোলিং না করা হলেও বছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। আর সাধারণত বিমা না থাকলেও ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের টোল না থাকলেও এ খাতে বছরে ২৫ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। মহাসড়কে চলাচলকারী বাসগুলো রংচটা ও লক্কর-ঝক্কর হলেও পাঁচ বছরে এগুলো রেনোভেশনের জন্য বছরে গড়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। আবার দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে বছরে ৬৫ হাজার টাকা এবং বাসের গ্যারেজ ভাড়া ৬৫ হাজার টাকা।

এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসেই চালক ও একজন সহকারী থাকলেও ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে চালকের দু’জন সহকারী ধরে তাদের দৈনিক ২ হাজার ১০০ টাকা হিসাবে বছরে বেতন ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। বোনাস বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। যদিও বেশিরভাগ বাসেই চালক ও সহকারীর কোনো বেতন-বোনাস নেই, বরং তাদের ট্রিপভিত্তিক চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিটি বাস দৈনিক ১২০ কিলোমিটার চলাচল করবে। প্রতি লিটারে আড়াই কিলোমিটার হিসাবে দৈনিক ডিজেল খরচ দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৮৪০ টাকা। এতে বছরে খরচ হবে ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা। বছরে দুটি ব্যাটারি বাবদ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় যুক্ত হয়েছে। এর সঙ্গে বছরে একটি ইঞ্জিন কুল্যান্ট কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ হাজার টাকা। এ ছাড়া বিআরটিএ ৩১ আসনের মিনিবাস ও ৫২ আসনের বড় বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এখন ঢাকায় ৩১-৪০ আসনের বাস চলছে। দূরপাল্লার পথে ২৬, ৪০ ও ৫২ আসনের বাস চলাচল করে, যে ক্ষেত্রে মালিকরা নিজেদের মতো করে ভাড়া নির্ধারণ করছেন।

এভাবে ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণে ১৬টি খাতের ব্যয় যোগ করে বছরে গড়ে বাস পরিচালনায় ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা। সঙ্গে বাস মালিকের ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রতি কিলোমিটার বাসভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২ টাকা ১৫ পয়সা। কিন্তু গণপরিবহণ মালিকদের কথামতো ব্যয় বিশ্লেষণ হিসাবের সময় প্রতিটি বাসের ট্রিপে কত যাত্রী হয়, বাসের বাজারমূল্য কত, বাসটি কত পথ পাড়ি দেয়-এসব কখনোই সরেজমিন যাচাই-বাছাই না করে বিআরটিএ একটি অঙ্ক বসিয়ে দেয়, যা মূলত গণপরিবহণ মালিকদের স্বার্থই নিশ্চিত করে।

দেশের ভোক্তারা বৃহত্তর অর্থনৈতিক গোষ্ঠী হলেও নীতিনির্ধারণীতে তাদের ভূমিকা বরাবরের মতো গৌণ। তাই সরকারকে সত্যিকারের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভোক্তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে; বিশেষ করে সরকারি সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রশাসনিক ও আর্থিক জবাবদিহিতাকে নাগরিক তদারকি ও পরিবীক্ষণের আওতায় আনতে হবে। নাগরিক অধিকার ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োজিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভোক্তা অধিকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সরকারি নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটি, গণপরিবহণ সেক্টরে জড়িত মালিক-শ্রমিক ও ভোক্তা (যাত্রীদের) নীতিনির্ধারণীতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এসব নাগরিক প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাড়ি ভাড়া, হোল্ডিং ট্যাক্স, নগর ব্যবস্থাপনা, শিল্প ও বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে নাগরিক ভোগান্তি নিরসনে গ্রাহক, সেবাদানকারী সংস্থা ও ভোক্তা প্রতিনিধি, প্রশাসনের সমন্বয়ে ত্রিপাক্ষিক গণশুনানির মাধ্যমে নাগরিক পরিবীক্ষণ, অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সুশাসন জোরদার করতে হবে। তাহলেই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ভোক্তাদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত হবে।

এস এম নাজের হোসাইন : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)